Wednesday 5 August 2020

নাটকের পরিসর ও নন্দনতত্ত্ব


পরিসরের ব্যাপ্তি কত ? তার কী কোনো সীমা থাকতে পারে ? উত্তরটা হ্যাঁ এবং না দুটোই হয় । গাণিতিক হিসেবে অবশ্যই " হ্যাঁ " কিন্তু কল্পনার চৌহদ্দিতে অবশ্যই " না " । আর এই পরিসর যদি নাটকের ভাবনায় স্থান পায় ? স্থান পায় নাটক নির্দেশনায় ? মানুষ নিজেকে নিয়ে কল্পনায় ভাসতে ভালোবাসে । তার এই স্বাভাবিক সুন্দর ভাবনা ফুটে ওঠে বিভিন্ন শিল্পকলায় ।

নাটক এমন একটি শিল্পকলা , যেখানে সব শিল্পের বিকাশের পরিপূর্ণতা দেখা যায় । তাই নাটককে মিশ্র শিল্পকলা বলা যেতেই পারে । তবে এই কলাবিদ্যাকে উপস্থাপিত করতে হয় যেহেতু মানুষের সামনে । তাই মানুষের মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হয় । নাটককে মূল্যবোধে উত্তীর্ণ করতে গেলে নাট্যঘটনাতেই চমকপ্রদ কিছু ছোটো ছোটো নীতিকাহিনির কোলাজ যুক্ত করেন নাটককার । তা আবার কখনো কখনো দর্শক মনোরঞ্জনের কারণ হয়ে ওঠে । আর সেখানেই নন্দনতত্ত্বের প্রসঙ্গ উঠে আসে । মনোরঞ্জনকে শীর্ষস্তরে নিয়ে যেতে হলে নন্দনতত্ত্বের ব্যবহার প্রাসঙ্গিক ।

সাদা কথায় নাটকের উপস্থাপনাতে সৌন্দর্য্যবোধের মোড়ক পড়ানোই নন্দনতত্ত্বের একমাত্র কাজ । যদি তা সঠিকভাবে ঘটনাচক্রের সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে যায় , তবে নাটক অবশ্যই সময়োচিত সমাজের দর্পন হয়ে ওঠে । যে-কোনো সামাজিক সমস্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে সেই সময়কালের সভ্যতার পরিকাঠামোকে একবার দেখে নেন পরিচালক । যে-কোনো বুর্জোয়া পরিস্থিতির সাথে আপোষহীন রফা তুলে ধরেন নাটককার তাঁর লেখা পাণ্ডুলিপিতে ।

উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে তার রূপ দেন পরিচালক মঞ্চে অথবা পথে । কিন্তু নন্দনতত্ত্বকে অস্বীকার করা , আর নুন ছাড়া ব্যঞ্জন তৈরি করা , ব্যাপারটা এক হয়ে দাঁড়ায় । তবে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতেই পারে মঞ্চসজ্জাতে কী নন্দনতত্ত্ব থাকে না ? উত্তর হলো অবশ্যই থাকে । তা নাটককে যথোচিত মর্য্যাদা দেয় । একটি নাটকের উপস্থাপনার সময় তার সম্পূর্ণ পরিসরের দিকে লক্ষ্য রাখলেই বুঝবেন , চরিত্র-নির্মাণ ও সেই চরিত্রকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নেওয়া , এই প্রতিটা বিষয়েই নন্দনতত্ত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে । নাটকের স্বার্থে উপযুক্ত চরিত্রায়ন মানেই বাচাই করে অভিনেতা নির্বাচন , অর্থাৎ সেখানে চরিত্রের সৌন্দর্য্যতা । এখানে চরিত্রের উপরেও নন্দনতত্ত্বের প্রভাব পড়লো নিঃসন্দেহে ।

তারপর আসা যাক অভিনয়ের মহড়া বা রিহার্সাল । পরিচালক প্রতিমুহূর্তে অঙ্গভঙ্গির কৌশল ও বাচিক অভিনয়ে উচ্চারণের এবং কথা বলার ধরণ শিখিয়ে দিচ্ছেন প্রতিটি অভিনেতাকে । সু-অভিনেতা সেই অভিনয়রীতির নন্দনতত্ত্বটি করায়ত্ব করছেন আর ব্যবহার করছেন তাঁর অভিনয়ে । দর্শকের কাছে তা দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠছে । এবং নাটকের অসম্ভাবীরূপ সেই থিয়েটার নিজেও মিশ্রকলার নন্দনতত্ত্বে দূরন্ত প্রযোজনাযোগ্য হয়ে উঠছে । তাহলে একটি নাটকের পরিসর বলতে শুধুমাত্র তার লিখিত রূপই বোঝায় না । উপস্থাপনারীতি সমেত তার সামগ্রিক রূপটাই বোঝায় । যদিও তখন তা হয়ে ওঠে থিয়েটার অথবা আধুনিক বক্তব্য অনুযায়ী নাট্য ।

নাটককার ও নির্দেশকের মনন একটি নাটকের ক্ষেত্রে অবশ্যই গঠনমূলক , তথাপি তাঁদের দু'জনের ভাবনাচিন্তায় বৈপরীত্য থাকলেও থাকতে পারে । হয়তো নাটককার যেভাবে উপস্থাপনা চাইলেন , সেভাবে নির্দেশক চাইলেন না । এক্ষেত্রে দু'জনের দৃষ্টিকোণ আলাদা ।

এক্ষেত্রে তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তা অনেকটাই প্রভাব ফেলে নাট্যকর্মে । যেহেতু একজন সামাজ সচেতন মানুষ কখনোই রাজনীতির বাইরে থাকতে পারেন না । "আমি রাজনীতি করি না" এমন কথা স্ব-দর্পে ঘোষণা করা মানুষটাও কিন্তু পরোক্ষ রাজনীতি করেন । সুতরাং নাটককার ও পরিচালকেরা দূর গ্রহের মানুষ নন এবং তাঁরা রাজনীতির বাইরেও নন ।

আসলে একজন নির্দেশককে উপস্থাপনারীতির সম্পূর্ণ আঙ্গিক দেখতে হয় । সেখানে সেট-সেটিংয়ের অবস্থান , ছোটো ছোটো স্পেসে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাপর্যায় , লাইটের সুপ্রসন্ন উপযুক্ত ব্যবহার , সাউণ্ড থ্রোয়িং মেশিন ও সাউণ্ড রিসিভারের ভিন্নতা অনুযায়ী অবস্থান , এইসব ব্যাপারগুলোতে ওয়াকিবহাল থাকতে হয় । সেক্ষেত্রে উপস্থাপনে কখনও কখনও কোনো কোনো দৃশ্যে কমপ্রোমাইজও করতে হয় । অভিনেতাদের অভিনয়-দক্ষতার উপর নির্ভর করে , তাদের থেকে সেরা অভিনয়টা বের করার জন্যেও পরিচালকের পূর্ব ভাবনাচিন্তার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটাতে হয় । নাটককার অনেকক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো মেনে নাও নিতে পারেন । সেক্ষেত্রে নাটককার ও নির্দেশকের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব থেকেই যায় ।

তাই উপস্থাপিত একটি নাটকের সামগ্রিক দিক তার পরিসরকে ব্যাখ্যা করে । এই উপস্থাপনরীতি যত সূক্ষ্ম হয়ে উঠবে , নাটকটি তত বেশিমাত্রায় নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ হবে । এর ফলে নন্দনতত্ত্বের সংজ্ঞা অনেক অনেক বেশি বিবৃতিমূলক হয়ে উঠবে । তবে একটা কথা এখানে ভীষণই প্রাসঙ্গিক । তা হল এই যে , ঐ বিশেষ নাটকটি কোন পরিবেশে উপস্থাপিত হবে ? নাটকটি যে দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হবে , তারা কোন শিক্ষাগত পর্যায়ের দর্শক ? তারা কী জাতীয় সংস্কৃতির বাহক ? তারা স্বভাবে উগ্র নাকি শান্ত ?

তবে এ ক্ষেত্রে অনেকেই বিদ্রোহী হয়ে উঠবেন এই বলে যে , এগুলোর উপর নাটকের মূলভাব অথবা অভিনয় ও পরিচালনারীতি কখনোই পরিবর্তিত হয় না । কথাটা কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সঠিক । আবার কিছুক্ষেত্রে সঠিক নয় । নাটকটি যদি বিতর্কিত বা রাজনৈতিক হয় , সেক্ষেত্রে নাটকটি ঐ পরিবেশের উপযুক্ত করে উপস্থাপনা করার সময় স্পর্শকাতর সংলাপগুচ্ছ অনেকসময় বাদ যায় । অভিনয়ের অঙ্গভঙ্গী ও সন্দেহের উদ্রেক হয় ; এমন কসটিউমের ব্যবহার ছাড়তে হয় । তাছাড়া আবার অনেকসময় সেট-সেটিংয়ের বাহুল্যতা বাদ দিতে হয় ।

আর যদি মঞ্চ-নাটককে অঙ্গনে উপস্থাপিত করতে হয় , তবে তো দিনের আলোতে লাইটের প্রয়োজন নেই । সেট-সেটিং প্রায় নেই বললেই চলে । অতিমাত্রিক মেক-আপের ব্যবহার নেই । অনেকসময় সাউণ্ড থ্রোয়িং মেশিন অথবা সাউণ্ড রিসিভার না থাকার জন্য অভিনেতাদের উচ্চগ্রামে স্বর তুলে অভিনয় করতে হয় । আওয়াজের তিক্ষ্ণতা বজায় রাখতে ও সব দর্শকের কানে সংলাপ পৌঁছে দেওয়ার জন্য অভিনেতারা অতি-সতর্ক হয়ে পড়েন । আর সেটাই স্বাভাবিক । সেক্ষেত্রে অভিনয়ের সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম মুদ্রাগুলো অজান্তেই তাদের অভিনয়ে ধরা পড়ে না । ফলে এখানে ঐ নির্দিষ্ট নাটকটির অভিনয়ে যে নন্দনতত্ত্ব বেরিয়ে এল , আর পূর্বে নাটকটির মঞ্চায়নে যে নন্দনতত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছিল , এ দুটির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থেকে যায় ।

এখন নাটকের দু'রকম পদ্ধতিতে উপস্থাপনায় ঐ নাটকটির পরিসর বিবর্ধিত বা সংকুচিত হতে বাধ্য । এক্ষেত্রে নাটকটির নন্দনতত্ত্বেও এক বিরাট ধাক্কা । সেক্ষেত্রে ঐ অবস্থায় উপস্থাপিত নাটকে নন্দনতত্ত্ব খুঁজে বের করা একটি গবেষণাধর্মী কাজ হয়ে দাঁড়ায় ।

বিপ্লবী নাটক এক জলন্ত অগ্নিকুন্ড, যেখানে সামাজিক জাতপাত ও অর্থনৈতিক দৈনতা পুড়তে থাকে দাউ-দাউ আগুনের শিখায় । তাই সেই নাটক যাতে পুরোপুরি রাজনৈতিক না হয়ে ওঠে, সে-বিষয়ে অনেকসময় পরিচালকও যথেষ্ট সচেতন থাকেন । এবং সেই সচেতনতা থেকেই তিনি তাঁর নাটকে বারংবার বিভিন্ন অঙ্গিকে সৌন্দর্যতার মোড়ক পড়ান । অর্থাৎ নন্দনতত্ত্বের প্রকাশ ঘটাতে থাকেন । সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই পরিচালক এটি করে থাকেন । কারণ বিপ্লবী নাটক বিনোদন হারিয়ে যেন সম্পূর্ণ রাজনীতির এক খসড়ায় পরিণত না হয় । আবার শিল্প সৃষ্টির একটি দায়ও অবশ্যই বর্তায় নাটকের ওপর । এই কারণেই মাধুর্যের ভঙ্গিতে নাটকে নাট্যকলা বলে ডাকা হয়ে থাকে । এবং অবশ্যই এটি একটি মিশ্র কলা । সকল প্রকার কলার একটি মিশ্রিত উপস্থাপন, আমরা প্রধানত নাটকেই দেখতে পাই । সেক্ষেত্রে যত বেশি ভিন্ন ভিন্ন কলার মিশ্রণ নাটকে থাকবে, নাটক তত বেশি নন্দনতাত্ত্বিক হয়ে উঠবে । তাই এ-কথা হলফ করে বলাই যায় যে, নাটকের পরিসর সর্বদা একটি বৃহৎ ক্রীড়দ্যোগের মাধ্যম । তা সে মঞ্চনাটক বা পথনাটক যা-ই হোক না কেন ।

বালকবেলার সবুজপাতায়




নদীর গহীন নাভিপটে ত্রিশূলের নিত্য তাণ্ডব ।
বিনোদনের সাতকাহনে বালকের খেলাঘর ।
হিসেবের সূর্যাস্তে রঙ মেখে মনোলোভা পাঠশালা,
এই আয়তনে শিউলির তল, খড়িমাটির আঁকতে উজ্জ্বল ।

মধ্যাহ্নের মৌ-বনে আজ ময়ূরবিহার, রাত জেগে ফেরা ডাক-হরকরা ।
বসন্তবাহার রাগে, বালিকার অনুরাগ নূপুর খুলেছে একজোড়া ।
তার ভেজা দু-পায়ের শিল্পসুষমা মাটির রসে মেঘলা অভিমানী ছাপ ফেলে যায় ।

চন্দ্রবোড়ার তৃষা, সান্ধ্য-মাধুরী ছিনিয়ে নিলে অস্থায়ী প্রজাপতি রং এনে দেয় মোহলতার ।

কেউটে গোখরোর মতো কুন্ডলিত কাহিনির সৌবর্ণ একাকার সরোবরের পদ্মপাতায় ।
সংস্কৃতি বাহুল্যবোধের শিক্ষাকে ঢেকে রাখে, নীলকণ্ঠ পাখির প্রহেলিকায় ।
অমায়িক শিশুর ঠোঁটে আধো-আধো কথা প্রাপ্তির খেয়াকে ভাসিয়ে দেয় ।
দীর্ঘদিনের খুনসুটি অযাচিত জলে থৈ থৈ, খেয়ালখুশির নাব্যতায় ।